Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
মাছেদের বিদেশ যাত্রা; শুন্য থেকে কোটিপতি বাংলাদেশ:
ডাউনলোড

২০১৪ সালের আগস্ট মাস। আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে সবে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেছি। মাসখানেক পরে ডাক পড়ল এটুআই প্রকল্পের "জনপ্রশাসনে উদ্ভাবন" বিষয়ক প্রশিক্ষণে।  মিজান স্যার, সানাউল স্যারদের  উৎসাহব্যঞ্জক কথায় ভাল কিছু করার সুপ্ত বাসনা প্রোথিত হয়েছিল তখনি।  ঠিক করলাম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সহজীকরনে কাজ করব। কিন্তু ব্যাপারটা কেন যেন ঠিক যুতসই মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আরো ভাল কিছু করা দরকার এবং সেটা সম্ভব। সারাক্ষণ এই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

    এক ছুটির বিকেলে ঘুরতে গেলাম কুলাউড়া থেকে প্রায় ৩৮ কিমি. দূরে ভারত সীমান্তবর্তী চাতলাপুর স্থলবন্দরে। সুন্দর ছোট্ট পরিপাটি স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের কৈলাশহর। কাঁটাতার দুই দেশকে আলাদা করতে পারলেও প্রকৃতির দুই পরমাসুন্দরী কন্যা যেন এপার আর ওপার।
এপার থেকে বিভিন্ন পন্য ওপারে যাচ্ছিল, ওপার থেকেও আসছিল।
হঠাৎ আমার নিউরনে একটা অনুরণন অনুভব করলাম- এসবের সাথে তো মাছও ভারতে রপ্তানি হতে পারে।
    

  কুলাউড়া উপজেলায় বাৎসরিক প্রায় ১৫০ টন মাছ উদ্বৃত্ত থাকে। বড় চাষিরা ভাল দাম না পেয়ে মাছ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে। আর যতটুকু জানি পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে মাছের ঘাটতিও আছে। রপ্তানি হলে সরকার রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও পেতে পারে। রপ্তানি সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ভাল আয়ের ব্যবস্থা হবে।
  ইমিগ্রেশন অফিসে খোজ নিয়ে জানলাম দুএকজন মাছ রপ্তানি করতে চায় কিন্তু সরকারি সহযোগিতার অভাবে হচ্ছে না।
    চাতলাপুর কাস্টমস এ যোগাযোগ করে জানতে পারলাম মাঝে মাঝে কিছু মাছ রপ্তানি হয়।কিন্ত  তাদের মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স নাই এবং মাছের গুনগত মান পরিক্ষা না করে মাছ পাঠানোর কারনে মাছ ফেরত আসে।
চিন্তা করলাম এখানে কাজ করার বিশাল সুযোগ আছে।
  কাস্টমস অফিস থেকে রপ্তানিকারকদের ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলাম। কয়েকজন বেশ আগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু লাইসেন্স প্রাপ্তির কঠিন শর্তসমূহ পালন করতে সবাই অপারগতা প্রকাশ করল।
যোগাযোগ করলাম মৎস্য অধিদপ্তরের "মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ" বিভাগের উপপরিচালক সালেহ আহমেদ স্যারের সাথে
- স্যার কিভাবে সহজে লাইসেন্স প্রদান করে মাছ রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করা যায়?
স্যার বিস্তারিত শুনে খুব খুশি হয়ে কাজে উৎসাহ দিলেন এবং বললেন
-তুমি যদি কয়েকটা লাইসেন্স করাতে পারো তাহলে তোমাকে রপ্তানিযোগ্য মাছের গুনগতমান পরিক্ষা করে স্বাস্থ্যকরত্ব সনদ প্রদানের বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হবে।
আমি ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম।
এর মধ্যে মৎস্য ভবনের মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সুজিত স্যার আমার অফিস ভিজিটে আসলেন এবং আমাকে নিয়ম কানুন সম্পর্কে ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন।
  আগ্রহী ব্যক্তিদের একটা করে প্যাকিং সেন্টার স্থাপন করতে বললাম, লাইসেন্স করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি নিলাম।কিভাবে প্যাকিং সেন্টার করতে হবে তা একজনকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে সহজ শর্তে কিছু কাগজপত্র দিতে বললাম। তার দেখাদেখি আরো তিনজন লাইসেন্স এর আবেদন করলেন।
 

মৎস্য ভবনে যোগাযোগ করে চার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স করাতে সমর্থ হই।
এরপর আবেদন করলাম স্বাস্থ্যকরত্ব সনদ প্রদানের ক্ষমতার প্রাপ্তির জন্য এবং ২০১৫  সালের সেপ্টেম্বর এ পেয়েও গেলাম।
দীর্ঘ ৭-৮ মাসের চেষ্টার পর শুরু হয়েছিল সেই কাংখিত মৎস্য রপ্তানি।
সীমিত পরিসরে শুরু হল রপ্তানি, কিন্তু দেখা গেল রপ্তানিকারকগণ সরকারের নির্ধারিত ২৫০০ টাকা না দিয়ে গুনগত মান পরিক্ষার স্বাস্থ্যকরত্ব সনদ না নিয়ে এবং মৎস্য দপ্তরকে না জানিয়ে রপ্তানি করছে। বাধ্য হয়ে কাস্টমস এর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লেখালেখি করে, উপজেলা নির্বাহি অফিসার নাজমুল হাসানের সহযোগীতা ও অনুপ্রেরণায় মোবাইল কোর্ট ও অভিযান পরিচালনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে।

এরপর নিয়ম মেনেই চলছিল সবকিছু।
এরপর ডাক পড়ল ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে। এই ছয় মাসে মাত্র তিনটি কনসাইনমেন্ট মাছ রপ্তানি হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৬ সালের এপ্রিলে এসে আবার কাজ শুরু করলাম।
পাঁচ মাসের চেষ্টায় সেপ্টেম্বর থেকে আবার পুরোদমে রপ্তানি শুরু হয়। সেই থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতিনিয়ত রপ্তানি বেড়েই চলছে।

গত তিন মাসে কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে বরফায়িত রুই, কাতলা, তেলাপিয়া, পাঙাশ, কার্পিও, পুটি ইত্যাদি মাছ রপ্তানি হয়েছে চুয়ান্ন হাজার কেজি, বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় এক কোটি আট লক্ষ টাকা, মৎস্য অধিদপ্তর রাজস্ব আদায় করেছে এক লক্ষ বত্রিশ হাজার পাঁচশত টাকা।
এই পরিসংখ্যান দুই বছর আগেও ছিল প্রায় শুন্যের কোঠায়।
 

বর্তমানে কুলাউড়া উপজেলার চাতলাপুর স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিমাসে হাজার হাজার কেজি বাংলাদেশে উৎপাদিত মাছ ভারতে রপ্তানী হচ্ছে। অর্জিত হচ্ছে লাখ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। সরকার পাচ্ছে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব। মৎস্য অধিদপ্তর থেকে সাত জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সারা বছর প্রচুর পরিমান মাছ রপ্তানী করে লাভের মুখ দেখছে। ঐসব প্রতিষ্ঠানে শত শত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য দপ্তরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে গুণগত মানসম্পন্ন মাছ রপ্তানী করে বিশ্বে বাংলাদেশে সম্মান অক্ষুন্ন রাখছে। অত্র এলাকার মাছচাষিরাও ভাল দামে মাছ বিক্রি করতে পারছে রপ্তানিকারকদের কাছে।